বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ, যেখানে জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে দেশের কৃষি ব্যবস্থায় নানা প্রযুক্তির সংযোজন ঘটেছে। তবে, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষণ, মাটির উর্বরতা হ্রাস এবং জনস্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এসব সমস্যা মোকাবিলার জন্য অর্গানিক কৃষি একটি সম্ভাবনাময় সমাধান হিসেবে দেখা যাচ্ছে

অর্গানিক কৃষি কী? অর্গানিক কৃষি হলো একটি টেকসই কৃষি পদ্ধতি যেখানে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও জিএমও (জেনেটিকালি মডিফাইড অর্গানিজম) ব্যবহার ছাড়া সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে ফসল উৎপাদন করা হয়। এতে প্রধানত জৈব সার, সবুজ সার, কম্পোস্ট এবং বায়োকন্ট্রোল পদ্ধতির মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণ করা হয়।
বাংলাদেশে অর্গানিক কৃষির গুরুত্ব – বাংলাদেশে অর্গানিক কৃষির গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছু প্রধান কারণ হলো:
স্বাস্থ্যকর খাদ্য: রাসায়নিক মুক্ত খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
পরিবেশ সংরক্ষণ: রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে মাটি, পানি ও বায়ুর দূষণ রোধ করা যায়।
মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি: অর্গানিক কৃষির মাধ্যমে মাটির পুষ্টিমান ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা সম্ভব।
রপ্তানি সম্ভাবনা: বিশ্ববাজারে অর্গানিক পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বাংলাদেশকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করতে পারে।
সাশ্রয়ী কৃষি ব্যবস্থা: রাসায়নিক সারের পরিবর্তে কম্পোস্ট, সবুজ সার ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপায় ব্যবহার কৃষকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হতে পারে।
বাংলাদেশে অর্গানিক কৃষির বর্তমান অবস্থা – বর্তমানে বাংলাদেশে অর্গানিক কৃষি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠান ও কৃষক গোষ্ঠী স্বতঃস্ফূর্তভাবে অর্গানিক কৃষির চর্চা শুরু করেছেন। দেশের কিছু অঞ্চল, যেমন নাটোর, দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা ও সিলেট, ইতোমধ্যে অর্গানিক কৃষিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। এছাড়া, বেশ কিছু এনজিও ও সরকারি সংস্থা কৃষকদের অর্গানিক কৃষি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা দিচ্ছে।
অর্গানিক কৃষির চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে অর্গানিক কৃষি সম্প্রসারণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
সচেতনতার অভাব: অনেক কৃষক অর্গানিক কৃষির সুফল সম্পর্কে সচেতন নন।
প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা: উন্নত জৈব সার উৎপাদন ও কীটপতঙ্গ দমনের জন্য গবেষণা ও প্রযুক্তিগত সহায়তার অভাব।
বাজারজাতকরণ সমস্যা: অর্গানিক পণ্য সাধারণত প্রচলিত পণ্যের তুলনায় ব্যয়বহুল, ফলে স্থানীয় বাজারে ক্রেতার অভাব দেখা দেয়।
সনদপ্রাপ্তির জটিলতা: আন্তর্জাতিক অর্গানিক সার্টিফিকেশন পাওয়া ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ।
প্রাথমিক উৎপাদন খরচ: রাসায়নিক কৃষি থেকে অর্গানিক কৃষিতে রূপান্তর প্রাথমিকভাবে ব্যয়বহুল হতে পারে।
সরকারি নীতির অভাব: অর্গানিক কৃষি প্রসারে শক্তিশালী সরকারি নীতি ও সহায়তা এখনো পর্যাপ্ত নয়।
অর্গানিক কৃষির সম্প্রসারণে করণীয়
বাংলাদেশে অর্গানিক কৃষি সম্প্রসারণে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি: সরকার ও এনজিওদের উদ্যোগে কৃষকদের অর্গানিক কৃষি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।
গবেষণা ও উন্নয়ন: অর্গানিক কৃষি নিয়ে গবেষণা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বাড়াতে হবে।
বাজার ব্যবস্থা উন্নয়ন: স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে অর্গানিক পণ্যের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা দরকার।
সরকারি প্রণোদনা: সরকারিভাবে অর্গানিক কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও ভর্তুকি প্রদান করা উচিত।
সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা সহজ করা: আন্তর্জাতিক অর্গানিক সার্টিফিকেশন সহজলভ্য ও কম ব্যয়বহুল করতে হবে।
কমিউনিটি-ভিত্তিক উদ্যোগ: স্থানীয় কৃষক সমবায় গঠনের মাধ্যমে অর্গানিক কৃষিকে এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশে অর্গানিক কৃষির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির ফলে মানুষ এখন রাসায়নিক মুক্ত খাদ্যের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। এছাড়া, বৈশ্বিকভাবে অর্গানিক পণ্যের বাজার দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সুযোগ। যদি যথাযথ পরিকল্পনা ও নীতিমালা গ্রহণ করা হয়, তাহলে আগামী দশকে অর্গানিক কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
উপসংহার
অর্গানিক কৃষি শুধু খাদ্য উৎপাদনের একটি পদ্ধতি নয়, বরং এটি একটি টেকসই কৃষি ব্যবস্থা যা পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জন্য লাভজনক। বাংলাদেশে অর্গানিক কৃষির সম্প্রসারণের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাস্থ্যকর ও পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারি। এজন্য সরকার, কৃষক, গবেষক ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।